![]() |
| শেখ হিশাম কাব্বানী |
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, নিউ হ্যাভেন, কানেকটিকাটে ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে মাওলানা শেখ হিশাম কাব্বানীর প্রদানকৃত পাবলিক লেকচারের ট্রান্সক্রিপ্টের অনুবাদ
আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন ওয়া আস-সালাতু ওয়া আস-সালামু আলা আশরাফিল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালিন।
বক্তব্য শুরু করার আগে আমি পবিত্র কুরআনের দুটি আয়াত তেলাওয়াত করব।
আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
رَبِّ قَدْ آتَيْتَنِي مِنَ الْمُلْكِ وَعَلَّمْتَنِي مِن تَأْوِيلِ الأَحَادِيثِ فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ أَنتَ وَلِيِّي فِي الدُّنُيَا وَالآخِرَةِ تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ
রাব্বি ক্বাদ আতাইতানি মিনাল মুলকি ওয়া আল্লামতানি মিন তা'উইলিল আহাদিস। ফাতিরাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বি আনতা ওয়ালিয়্যি ফিদ দুনিয়া ওয়াল আখিরাহ, তাওয়াফফানি মুসলিমাইন ওয়া আলহিকনি বিস সালিহীন।
অর্থ: "হে আমার পালনকর্তা! আপনি আমাকে রাজত্ব দান করেছেন এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। হে আসমান ও জমিনের স্রষ্টা! ইহকাল ও পরকালে আপনিই আমার অভিভাবক। আমাকে মুসলিম হিসেবে মৃত্যুদান করুন এবং নেককারদের সাথে মিলিত করুন।" (সূরা ইউসুফ, ১২:১০১)
আমান্না বিল্লাহি সাদাকাল্লাহুল আজিম। সুবহানা রাব্বিকা রাব্বিল ইজ্জাতি আম্মা ইয়াসিফুন ওয়া সালামুন আলাল মুরসালিন ওয়াল হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।
সম্মানিত সুধী, মহান আল্লাহ তায়ালা আপনাদের সবাইকে বরকত দিন। আমি জানি না কী বলব। আজ রাতে আপনাদের সাথে থাকতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি। এটি আমার জন্য অনেক আনন্দের বিষয়, কারণ, আমি এমন কেউ নই যে অনেক কিছু জানে। আমি 'শূন্য' হতে চাই। ‘শূন্য’ আমার একটি পছন্দের সংখ্যা। এর মানে হলো নিজেকে বড় মনে না করা বা আত্মপ্রশংসা না করা। বরং, একজন সাধারণ মানুষ হয়ে থাকা, মানুষের কথা শোনা এবং তাদের কাছ থেকে শেখা। কারণ আমরা একে অপরকে ছাড়া শিখতে পারি না। আর একে অপরের কাছ থেকে শেখা আমাদের জন্য অনেক পথ আর অনেক দরজা খুলে দেয়।
যখন তারা এই আলোচনার শিরোনাম দিল "ইনভোকিং দ্য বিলাভেড" বা "প্রিয়জন তথা প্রেমাস্পদকে আহ্বান", তখন আমি নিজেকেই প্রশ্ন করলাম "এর মানে কী? কবিতা ও সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রেমাস্পদকে আহ্বান?" তখন আমার অন্তরে এই ছোট কবিতাটি ভেসে উঠল:
‘যখন জাহান্নাম সৃষ্টি হলো, ফেরেশতাদের হৃদয় নির্ধারিত জায়গা থেকে উড়ে গেল
আবার, যখন মানুষ সৃষ্টি হলো, সেই হৃদয়গুলো আবার ফিরে এল।’
তাই আমি ভাবছিলাম আমরা কীভাবে এবং কোথায় ফিরে আসব? আমরা ফিরে এসেছি যখন আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন। আমরা এবং ফেরেশতারা একত্র হয়েছি যাতে তারা আমাদের শেখাতে পারেন কীভাবে প্রেমাস্পদকে ডাকতে হয়। "প্রেমাস্পদকে আহ্বান" মানে কাউকে ডাকা এবং আশা করা যে সেই সত্তা সাড়া দেবেন। তাই এটি কেবল সাড়াবিহীন আহ্বান নয়। বরং এটি দুপক্ষের মধ্যে একটি পারস্পরিক বিষয়। কেউ একজন ডাকছেন এবং যাকে ডাকা হচ্ছে তিনি উত্তর দিচ্ছেন।
তাই যদি আমরা কোনো উত্তর শুনতে না পাই তার মানে এই নয় যে আমাদের প্রেমাস্পদ আমাদের ডাকেননি। উদাহরণস্বরূপ আমরা জানি প্রতিটা মানুষ তাকেই ডাকে যাকে সে ভালোবাসে। রোমিও এবং জুলিয়েট একে অপরকে ডাকে, একজন কিছু বলে অন্যজন তার উত্তর দেয়। আপনি নিজের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না, তা করলে লোকে আপনাকে পাগল বলবে। তাই শোনার এবং উত্তর দেওয়ার জন্য আপনার কাউকে প্রয়োজন। রোমিও এবং জুলিয়েট একে অপরের কথা শুনত এবং উত্তর দিত। যখন একজন মারা গেল তখন অন্যজনও মৃত্যুর দিকে গেল, অর্থাৎ, অনুসরণ করল। সে বলেনি "সে মরেছে, কিন্তু, আমি মরব না", বরং সে তার প্রেমাস্পদের মৃত্যুতে নিজেও মৃত্যুবরণ করল।
একইভাবে আমরা ডাকি এবং আশা করি যে কেউ আমাদের ডাকে সাড়া দেবে। যেমন ড. হুমায়রা উল্লেখ করেছেন, কবি জালালুদ্দিন রুমি (কাদ্দাসাল্লাহু সিররুহু) তাঁর কবিতার সাথে সংযুক্ত ছিলেন কারণ কবিতা হলো অনুভূতির প্রতিফলন। যখন আপনি কবিতা ও সঙ্গীত শোনেন তখন আপনার শরীরে একটি প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় এবং আপনার অনুভূতির প্রতিফলন ঘটে যা আপনাকে সেই কবিতার সাথে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে সাহায্য করে, যে ভাষায় আপনি আপনার সেই প্রেমাস্পদকে ডাকতে পারেন- যাকে আপনি ভালোবাসেন। তাই জালালুদ্দিন রুমি (কাদ্দাসাল্লাহু সিররুহু) তাঁর জীবনের শুরুর দিকের অনুভূতিগুলোই তাঁকে কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেই সময়ে তিনি প্রেমাস্পদকে ডাকছিলেন কিন্তু তখনও তিনি কোনো উত্তর শুনতে পাননি। কারণ তিনি তখনও সেই সংযোগ স্থাপনের মতো পরিপক্কতার স্তরে পৌঁছাননি।
যেমন, ড. হুমায়রা উল্লেখ করেছেন, যখন আল্লাহ রুহদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন "আমি কি তোমাদের রব নই?" এবং আমরা উত্তর দিয়েছিলাম "হ্যাঁ, আপনিই আমাদের রব।" সেখানে প্রেমাস্পদের কাছ থেকে একটি প্রশ্ন এসেছে এবং সেই ঐশ্বরিক উপস্থিতিতে আমাদের কাছ থেকে একটি উত্তর। তাই জালালুদ্দিন রুমি (কাদ্দাসাল্লাহু সিররুহু) তাঁর কবিতার মাধ্যমে সেই ডিভাইন প্রেজেন্স বা পবিত্র স্বর্গীয় উপস্থিতিতে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর অনুভূতি ব্যবহার করে প্রেমাস্পদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। যখন তিনি প্রথম তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করতে শুরু করলেন তখন তিনি কোনো উত্তর শুনতে পাননি। কিন্তু তিনি থেমে যাননি বা বলেননি যে "আমি হেরে গেছি বা প্রত্যাখ্যাত হয়েছি।" তিনি দরজায় কড়া নাড়তে থাকলেন, কবিতা লিখতে থাকলেন এবং নিজেকে প্রকাশ করতে থাকলেন যতক্ষণ না একদিন তিনি নিজেকে উপরে উঠতে দেখলেন। যখন তিনি ঘুরছিলেন (whirling) তখন তিনি উপরে উঠতে শুরু করলেন। শুরুতে তিনি কেবল ঘুরছিলেন আর ঘুরছিলেন কিন্তু, তখনও তিনি মেঝেতেই ছিলেন। কিন্তু যখন সেই প্রতিফলন এবং সংযোগ স্থাপিত হলো তিনি উপরে উঠতে শুরু করলেন। আজ আমরা বিজ্ঞানে জানি যখন কোনো টারবাইন বা জেনারেটর ঘোরে তখন তা এমন শক্তি উৎপাদন করে যা বিমানকে উড়তে সাহায্য করে বা জেনারেটরে বিদ্যুৎ দেয়। তাই তিনি তাঁর ঘূর্ণন এবং তাঁর প্রভুর সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে সেই সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি উপরে উঠছিলেন আর উঠছিলেন অথচ তাঁর অনুসারীরা তখনও মাটিতেই ছিল। তাই মানুষের ভেতরে কবিতার প্রতিফলন ভিন্নভাবে আপনাকে আন্দোলিত করে।
গতি বা নড়াচড়া মহাবিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেখুন পৃথিবী কীভাবে তার অক্ষের চারপাশে ঘুরছে। কে তাকে ঘোরাচ্ছে? আপনারা কি মনে করেন পৃথিবী তার স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছে না? আপনারা কি মনে করেন পৃথিবী তার অক্ষের চারপাশে ঘুরে তার স্রষ্টার জন্য আনন্দ করছে না? প্রেমাস্পদকে খুশি করছে না? আমরা যদি শুনতে না পাই তবে অন্যরা শুনতে পায়। কারণ এটি সুপ্রতিষ্ঠিত এবং অনেক ধর্মে বলা হয়েছে, "যতক্ষণ আমার বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার কাছে আসে আমি তাকে ভালোবাসি। যখন আমি তাকে ভালোবাসি আমি তার কান হয়ে যাই যা দিয়ে সে শোনে, আমি তার চোখ হয়ে যাই যা দিয়ে সে দেখে, আমি তার জিহ্বা হয়ে যাই যা দিয়ে সে কথা বলে, আমি তার হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে কাজ করে, আমি তার পা হয়ে যাই যা দিয়ে সে চলে।" তাই, যখনই আপনি আপনার এবং আপনার প্রেমাস্পদের মধ্যে সেই ভালোবাসা স্থাপন করবেন, আপনি এমনভাবেই কান পেতে রইবেন যেন সবকিছু শোনা যায়। আপনার অন্তরের সেই শক্তির তুলনায় এটি খুব বেশি কিছু না, কিছু প্রতিফলন মাত্র!
আপনি এমন জিনিসের উপস্থিতি অনুভব করতে পারেন যা আপনি জীবনে কখনও আশা করেননি। যেমন এই ঘরে এখন আমাদের মাথার উপরে কি কিছু আছে? কিছু কি নড়াচড়া করছে? মানুষ যদি বলে "না, কিছুই নড়ছে না", আমি বলব, ‘না’, অনেক কিছুই নড়ছে কিন্তু আমরা তা দেখতে পাচ্ছি না। যেমন মৌমাছিরা তাদের চোখ দিয়ে অতিবেগুনি (UV) রশ্মি দেখতে পায় যা আমরা আমাদের চোখ দিয়ে দেখতে পাই না। তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে ৪০০ কিমি পর্যন্ত উড়তে পারে। আর এই সবকিছু তাদের অন্তরের প্রেরণা থেকে আসে যা প্রেমাস্পদকে ডাকার মাধ্যমে তৈরি হয়। তারা আমাদের জন্য মধু সংগ্রহ করতে যায়, তারা ওড়ে। তাই এই চমৎকার চ্যাপেলে যখন আমি প্রবেশ করলাম আমি এখানে চিরকাল থাকতে চাইলাম। যেমন ভার্জিন মেরী বা মা মারিয়াম (আলাইহাসসালাম) যখন তাঁর মেহরাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং তিনি সেখানে চিরকাল ছিলেন। যখনই নবী যাকারিয়া (আলাইহিসসালাম) তাঁর কাছে আসতেন তিনি তাঁর কাছে সব ধরণের ফল এবং খাবার দেখতে পেতেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেন "তোমার জন্য এই খাবার কোথা থেকে আসে?"
তিনি বলতেন "আল্লাহ প্রতিদিন আমার জন্য পাঠান।" এবং তিনি কখনও বাইরে যেতেন না কারণ তিনি প্রেমাস্পদকে ডাকছিলেন, তিনি সেই প্রিয়তমকে ডাকছিলেন।
মা মারিয়াম (আলাইহাসসালাম) এর কারণে সেই স্থানটি পবিত্র হয়ে গিয়েছিল। যাকারিয়া (আলাইহিসসালাম) স্থানটির গুরুত্ব বুঝতে পেরে সেই স্থানে ফিরে গিয়ে ৯৯ বছর বয়সে সন্তান লাভের জন্য প্রেমাস্পদকে ডাকলেন। আল্লাহ তাঁকে একটি সন্তান দিলেন তিনি হলেন জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট বা হযরত ই ইয়াহিয়া (আলআইহিসসালাম)। তাই এখানে এই সুন্দর চ্যাপেলে আমরা ছাড়াও অনেক কিছুই নড়ছে, অনেক তরঙ্গ, অনেক ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন এবং তরঙ্গ। যদি সঠিক যন্ত্রপাতি থাকে তবে এই তরঙ্গগুলোকে আপনি ছবি এবং শব্দে পরিণত করতে পারেন। আমাদের যদি টিভি থাকে, যথাযথ সাউন্ড সিস্টেম থাকে তবে আমরা এই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গগুলো শুনতে পারি। সেই শব্দ তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যা প্রেমাস্পদকে ডাকছে। যা আমরা শুনতে পাচ্ছি না, কারণ শব্দ প্রতি সেকেন্ডে ৩,০০,০০০ কিমি বেগে চলে। এটি যেখান থেকেই আসুক না কেন তা নড়ছে। এমনকি এই চ্যাপেলের পেছন থেকেও ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ আসতে পারে। তাই প্রেমাস্পদকে ডাকার ব্যাপারে আপনারা কী মনে করেন? এটি এমন একটি তরঙ্গ যা আসমানে যায়। এজন্যই কবি বলেছেন:
তিনিই প্রথম যার কোনো শুরু নেই এবং তিনি পূজনীয়।
তিনিই অনন্ত যার কোনো শেষ নেই।
তিনিই একমাত্র যিনি সৃষ্টি করেন এবং আবিষ্কার করেন।
তিনি তাঁর রাজত্বের মালিক ও শাসক,
দৃশ্য এবং অদৃশ্য, ফেরেশতা এবং মানুষ উভয়েরই।
কোনো কিছুই তাঁকে ধারণ করতে পারে না বরং তিনি সব কিছু ধারণ করে আছেন।
তিনি স্বয়ম্ভু, যিনি সাত আসমান ও সাত জমিন
এবং সমস্ত বিশ্বজগৎ তাঁর ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছেন।
তিনি তাঁর পূর্ণাঙ্গ গুণাবলীতে অদ্বিতীয়, তিনি চিরঞ্জীব, তিনি অনন্ত,
যার জীবনের কোনো শেষ নেই। তিনি তাঁর আদি জ্ঞানে সর্বজ্ঞ।
তিনি সৃষ্টিতে নিপুণ, জ্ঞানে সর্বব্যাপী, গোপন এবং প্রকাশ্য উভয়ই।
তিনি তাঁর নিজের একত্বের সাক্ষী,
তিনি সর্বশ্রোতা শোনার আবশ্যকতা ছাড়াই,
তিনি সর্বদ্রষ্টা তাকানোর আবশ্যকতা ছাড়াই,
যিনি তাঁর ফেরেশতা এবং বান্দাদের কোনো বিষয়েই উদাসীন নন।
তিনি সেই রক্ষক যিনি কখনও ভুলেন না, তাঁর সৃষ্টির অভিভাবক,
সর্বশক্তিমান যিনি অসীম সৃষ্টিকে অস্তিত্বে এনেছেন।
তিনি সবাইকে রিজিকদাতা চাওয়া ছাড়াই।
তিনি নূরের নূর, তিনি প্রভুদের প্রভু,
রাজাধিরাজ যার সামনে তাঁর বিশ্বাসীদের অন্তর আলোকিত হয়।
তাঁর উদারতার স্রোতে তাঁর রাজত্ব কমে না
যেমন অসীম সমুদ্রের ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ে,
কলম আর লিখতে পারে না, কালি শেষ হয়ে যায়।
এটি একজন আরবি কবির লেখা।
রাসুলুল্লাহ ﷺ এর রিসালাতের আগে আরবরা কবিতায় খুব বিখ্যাত ছিল। তারা হাজার হাজার লাইন লিখত, তারা কবিতায় কথা বলত, কারণ, ধ্রুপদী আরবি সাহিত্য কবিতা আকারেই রচিত। তাই তারা কবিতায় কথা বলে। যখন নবীজী ﷺ এলেন এবং এই সমস্ত জীবন্ত মানুষকে অসভ্য থেকে সভ্য মানুষে পরিণত করলেন তখন তাদের কবিতাতেও পরিবর্তন এলো এবং তারা কবিতায় তাদের প্রেমাস্পদকে ডাকতে শুরু করল। যখন তারা প্রেমাস্পদকে ডাকতে শুরু করল আমরা এমন এমন কবিতা পেলাম! যেমন, মহিউদ্দিন ইবনে আরাবি (কাদ্দাসাল্লাহু সিররুহু) এর, মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (কাদ্দাসাল্লাহু সিররুহু) এর নয়। এটি খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন কিন্তু, আমি এটি এমন একজনের পাণ্ডুলিপিতে পেয়েছিলাম যিনি মহিউদ্দিন ইবনে আরাবি (কাদ্দাসাল্লাহু সিররুহু.) সম্পর্কে বলেছিলেন এবং আমরা এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছি।
আর আল্লাহ কী বলেন?
قُل لَّوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَادًا لِّكَلِمَاتِ رَبِّي لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ أَن تَنفَدَ كَلِمَاتُ رَبِّي وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِ مَدَدًا
কুল লাউ কানাল বাহরু মিদাদাল লিকালিমাতি রাব্বি, লানাফিদাল বাহরু কাবলা আন তানফাদা কালি মাতু রাব্বি ওয়া লাউ জি'না বিমিসলিহি মাদাদা।
অর্থ: বলুন (হে মুহাম্মদ ﷺ), "আমার পালনকর্তার কথা লেখার জন্য যদি সমুদ্রের পানি কালি হয়, তবে আমার পালনকর্তার কথা শেষ হওয়ার আগেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে। সাহায্যার্থে যদিও এর সাথে আমি তদ্রূপ আরও সমুদ্র নিয়ে আসি।" (সূরা কাহফ, ১৮:১০৯)
হে মানুষ! যাকে আপনি ভালোবাসেন তাকে ডাকা বা স্মরণ করাই হলো সবকিছুর চাবিকাঠি। তিনি আমাদের ডাকছেন! তিনি অনেক জায়গায় বলেছেন:
أَنَا جَلِيْسُ مَنْ ذَكَرَنِي
আনা জালিসু মান জাকারানি।
আমি তার সাথে বসি যে আমাকে স্মরণ করে। (আহমদ, বায়হাকি)
"আমি তার সাথে বসে আছি যে আমাকে ভালোবাসে।" এবং অন্য একটি বাণীতে আছে "আমাকে স্মরণ করো এবং আমার সম্পর্কে খুব বেশি বলো যতক্ষণ না মানুষ তোমাকে পাগল মনে করে! সমস্যা নেই, তাদের বলতে দাও তুমি আমার প্রেমে পাগল কিন্তু তুমি আমার কাছে এসো!" এবং যেমন তিনি এই কবিতায় বলেছেন:
আমি তাদের স্মরণ করি যারা আমাকে স্মরণ করে,
আমার বাগান তাদের জন্য যারা আমার ইবাদত করে,
আমি তাদের দেখতে যাই যারা আমাকে মিস করে,
এবং আমি তাদের জন্য বিদ্যমান যারা আমাকে ভালোবাসে।
একজন প্রেমিক যে ভালোবাসে তার কথা সত্য!
যে তার প্রেমিকের সাথে অন্তরঙ্গ তার কাজ সর্বদা সঠিক!
যে আমার সাথে দেখা করতে ভালোবাসে, আমিও তার সাথে দেখা করতে ভালোবাসি!
এটি মহিউদ্দিন ইবনে আরাবি (কাদ্দাসাল্লাহু সিররুহু) এর কবিতা, যিনি ইসলামের ইতিহাসে এত বড় ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে তিনি এমন সব বই লিখেছেন যা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। এটি আমাদের চিন্তার বাইরে। তাঁর বইগুলো আরবিতে। কিছু কিছু অনুবাদ করা হয়েছে এবং প্রধানটি হলো 'আল-ফুতুহাত আল-মাক্কিয়া' যা চৌদ্দ খণ্ডে রচিত। আপনি যদি আরব না হন তবে আমি নিশ্চিত যে তিনি এই বইগুলোতে যে অর্থ রেখেছেন তার অনেক কিছুই আপনি মিস করবেন। এবং সাধারণ আরব নয়, সেই লেখা বোঝার জন্য একজন কবি বা খুব শিক্ষিত ও বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তির প্রয়োজন।
তাহলে আমাদের প্রভুর কাছে যাওয়ার পথ কী? আধ্যাত্মিকতা এবং ইসলামি শিক্ষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন পণ্ডিত এক ভাবমগ্ন অবস্থায় বা 'হাল'-এ পৌঁছেছিলেন এবং অনেক পিএইচডি ছাত্র তাঁর বই ব্যাখ্যা করে লিখেছেন। তিনি হলেন বায়েজিদ আল-বোস্তামী (কাদ্দাসাল্লাহু সিররুহু)। তিনি একবার বলেছিলেন, "হে আমার প্রভু! আমাকে তোমার পথ দেখাও।" তিনি প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা বসে ধ্যান করতেন এবং প্রার্থনা করতেন এবং নবীজী ﷺ এর পথ অনুসরণ করতেন যেখানে তিনি ﷺ বলেছেন:
تفكر ساعة خير من عبادة سبعين سنة
তাফাক্কারু সা'আতিন খাইরুম মিন ইবাদাতি সাবা'ঈন সান্নাহ।
এক মুহূর্ত আল্লাহকে স্মরণ করা (চিন্তা বা ধ্যান করা) সত্তর বছরের ইবাদতের চেয়ে উত্তম।
তাই বায়েজিদ আল-বোস্তামী (কাদ্দাসাল্লাহু সিররুহু) আল্লাহকে ডাকছিলেন "হে আমার প্রভু! আমার জন্য খুলে দাও, আমার জন্য খুলে দাও, আমার জন্য তোমার জ্ঞান খুলে দাও, আমার জন্য তা খুলে দাও! তোমার কাছে আসার পথ আমাকে দেখাও!"
এবং তিনি একটি আওয়াজ শুনলেন "হে আবু ইয়াজিদ, তুমি কি আমার কাছে আসতে চাও?"
তিনি বললেন "হে আমার প্রভু, অবশ্যই আমি তোমার কাছে আসতে চাই। আমি দিনরাত তোমাকে ডাকছি।"
আল্লাহ বললেন "হে আবু ইয়াজিদ, তোমার কাছ থেকে আমার একটি জিনিস প্রয়োজন। যদি তুমি তা করো তবে আমি তোমার জন্য আমার দরজা খুলে দেব।"
বায়েজিদ বললেন "হে আমার প্রভু, আমি প্রস্তুত।"
তিনি বললেন, 'উতরুক নাফসাকা ওয়া তা'আল', "তোমার আমিত্ব বা ইগো, তোমার নফসকে পেছনে ফেলে আমার কাছে এসো। আমি তোমার ভেতরে দুজন মানুষকে চাই না যারা আমার কাছে আসবে, আমি একজনকে চাই।"
"তোমার আমিত্ব ছাড়ো" মানে হলো যেহেতু আমরা আমাদের নফস এবং ইগোর প্রভাবে আছি তাই "তোমার ইগো ছাড়ো এবং তোমার রুহ নিয়ে আমার কাছে এসো। যদি তুমি তা করো তবে আমি তোমার জন্য দরজা খুলে দেব।"
এজন্যই বলা হয়েছে:
من عرف نفسه فقد عرف ربه
মান আরাফা নাফসাহু ফাক্বাদ আরাফা রাব্বাহু।
যে নিজেকে চিনল (এবং নিজের সীমাবদ্ধতা জানল) সে তার প্রভুকে চিনল।
তাই আমাদের নিজেদের জানার যাত্রা শুরু করতে হবে। আমাদের যা করার অনুমতি নেই এবং আমরা যা করছি তা বন্ধ করতে হবে যাতে আমাদের জন্য পথ খুলে যায়। এটি একটি মারেফতের পথ বা 'নস্টিক' পথ। এটি রাস্তার কোনো সাধারণ পথ নয়, ফিকহ বা হাদিস ও পবিত্র কুরআন বোঝার সাধারণ পথ নয়। না, এটি এমন একটি পথ যা আপনাকে প্রতিটি ধর্মের প্রতিটি আয়াতের পেছনে আসলে কী আছে তা বুঝতে সাহায্য করে। যেমন ইহুদি সম্প্রদায়কে অবশ্যই মুসা (আলাইহিসসালাম) এর প্রতিটি আদেশ স্পষ্টভাবে অনুসরণ করতে হবে। খ্রিস্টান সম্প্রদায়কেও যিশু বা ঈসা (আলাইহিসসালাম) যা নিয়ে এসেছেন তার সব কিছু অনুসরণ করতে হবে। এবং মুসলমানদেরও নবীজি ﷺ যা নিয়ে এসেছেন তা অনুসরণ করতে হবে। তাই যদি আমরা আমাদের ধর্ম নিয়ে এগিয়ে যাই, অন্য ধর্মের সাথে তারতম্য না করি, তর্ক না করি বরং একে অপরের সাথে সম্পর্ক গড়ার জন্য কাজ করি তবে আমরা সেই প্রেমাস্পদকেই ডাকছি। কারণ মুসা (আ.) এর মাধ্যমে ইহুদি সম্প্রদায় আল্লাহকেই ডাকছে, খ্রিস্টানরাও তাই করছে এবং মুসলমানরাও তাই করছে। তাই আমরা একই সত্তাকে ডাকছি কিন্তু ভিন্ন নামে। তাই যখন আমরা নিজেদের চিনতে পারি এবং নিজেদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানি, নিজেদের ধর্ম এবং অন্য ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক জানি-বুঝি, তখন আল্লাহ আমাদের ওপর খুশি হবেন এবং আমরা যা চাইছি তিনি তাতে সাড়া দেবেন।
আমি এটি উল্লেখ করব: "বলুন, 'আল্লাহর অনুগ্রহে ও তাঁর রহমতে, সুতরাং এতেই যেন তারা আনন্দিত হয়।' তারা যা সঞ্চয় করে এটি তার চেয়ে উত্তম।"
قُلْ بِفَضْلِ اللّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُواْ هُوَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ
কুল বি-ফাদলিল্লাহি ওয়া বি-রাহমাতিহি ফা বিজালিকা ফাল-ইয়াফরাহু হুয়া খাইরুম মিম্মা ইয়াজমাউন।
অর্থ: বলুন, "আল্লাহর অনুগ্রহে ও তাঁর রহমতে, সুতরাং এতেই যেন তারা আনন্দিত হয়। তারা যা (ধন-সম্পদ) সঞ্চয় করে এটি তার চেয়ে উত্তম।" (সূরা ইউনুস, ১০:৫৮)
তিনি আমাদের বলছেন "আমার রহমতের দিকে এসো যা আমি তোমাদের জন্য খুলে দিয়েছি এবং তাতে আনন্দ করো। এসো যা আমি পছন্দ করি, দয়ালু হও এবং একে অপরের প্রতি দয়ালু হও।" এজন্যই কবি বলেছেন:
আমরা তোমার কাছে এসেছি এবং তুমিই আমাদের এনেছ,
আমরা আসিনি,
আমরা প্রথম পদক্ষেপে প্রেমাস্পদকে ডাকার চেষ্টা করেছি এবং তিনিই আমাদের এনেছেন।
তুমি যা করো তার ছাড়া আর কিছুই আমরা চাই না,
তোমার দরজা বিশাল। তোমার দরজা সবাইকে নিতে পারে!
হে মুসলমানগণ, এটি বন্ধ করবেন না! হে খ্রিস্টানগণ, এটি বন্ধ করবেন না! হে ইহুদি সম্প্রদায়, এটি বন্ধ করবেন না! মূর্তি পূজারিরা, এটি বন্ধ করবেন না! দরজাটি খুলুন এবং সবাইকে প্রবেশের জন্য এটিকে প্রশস্ত হতে দিন। আর বিচারের ভার আমাদের প্রভুর, আমাদের নয়। মানুষকে বিচার করবেন না, প্রেমাস্পদকে বিচার করতে দিন। আর প্রেমাস্পদ কি ছোটদের বিচার করবেন? আপনার সেখানে একটি বাচ্চা আছে, আমি আমার পেছনে তার কান্না শুনলাম, আমি কি তাকে কোনো কথা বলতে পারি? না। তার বয়স দুই বছর এবং আমরা আমাদের প্রভুর দৃষ্টিতে এখনও শিশু। যখন আমরা পড়ে যাই তিনি আমাদের দাঁড় করান। আমরা এদিকে পড়ে যাই এবং তিনি বলেন "স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসো।" আমরা ওদিকে পড়ে যাই, তিনি বলেন “স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসো।” আমাদের প্রভু আল্লাহ কি তাহলে আমাদের মত শিশুদের বিচার করবেন? যদিও তিনি আমাদের মন, শরীর, আত্মা দিয়েছেন তবুও আমরা তাঁর দৃষ্টিতে শিশু। এজন্যই রুমি বলেছেন "তোমার দরজা বিশাল।"
“তোমার দরজা বিশাল।
এর চৌকাঠ হলো তোমার উদারতা।
গরিবরা তাদের লক্ষ্যের জন্য তোমার কাছেই পৌঁছায়।
আর আমরা তাঁকে ডাকার ক্ষেত্রে, তাঁকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে গরিব।
তোমার সাক্ষাৎ ছাড়া অন্য সবকিছুর জন্য ধৈর্য ভালো।
আমরা ধৈর্য ধরতে পারি, কিন্তু যখন তোমার সাথে সাক্ষাতের কথা আসে আমরা ধৈর্যশীল নই, আমাদের তা দ্রুত প্রয়োজন!
হে আমার প্রভু! আমি তোমার কাছে একটি বিভ্রান্ত মনের অভিযোগ তুলে ধরছি।
আশা আমাকে মাতাল করেছে। আমি মন্দ লোকদের কষ্ট ভুলে গেছি।
তুমি আমার অবস্থা আমার চেয়ে ভালো জানো। আমাকে তোমার প্রেমের মদে মাতাল অবস্থায় রেখো না।
তোমার পূর্ণ উদারতার মাধ্যমে আমাকে ক্ষমা করো।
তুমি আমার হৃদয়ের মালিক। এটি তোমারই বাণী। আমাকে তোমার থেকে আলাদা করো না।
আমাকে তোমার সান্নিধ্যে উন্নীত করো যেখানে আমি সর্বদা তোমাকে দেখব।”
যদি আমরা এই পৃথিবীতে আমাদের প্রিয়জনকে না দেখি তবে আমরা বলি "আমি আমার প্রিয়জনকে দেখিনি"। ছেলে বা মেয়ে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণরা প্রতিদিন তাদের প্রিয়জনকে দেখতে চায় এবং যদি না দেখে তবে তারা সব জায়গায় খোঁজে। ভাবে "জানি না কোথায় গেল মানুষটা!" (মোবাইলের মাধ্যমে খোঁজা, একে অপরকে টেক্সট করা)। আমি দেখেছি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক মুহূর্তও মানুষ একে অপরকে টেক্সট না করে থাকতে পারে না। তারা কী টেক্সট করছে আমরা জানি না, সেই কথা আমরা বাদ দিই! (হাসি)
তোমার পূর্ণ উদারতার মাধ্যমে আমাকে ক্ষমা করো। তুমি আমার হৃদয়ের মালিক।
এটি তোমারই বাণী। আমাকে তোমার থেকে আলাদা করো না।
আমাকে তোমার সান্নিধ্যে উন্নীত করো যেখানে আমি সর্বদা তোমাকে দেখব।
তুমি আমার গোপন রহস্য, তুমি আমার সূর্য, তুমি আমার ভালোবাসা, তুমি আমার সব কিছু।
আমার জিহ্বা জমে গেছে, আমার কলম লিখতে পারে না, আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, আমার মন ভাবতে পারে না,
হে আমার প্রভু, আমার জন্য সব রহস্য মুক্ত করে দাও!
আর আমি এ প্রেমে ডুবে যাচ্ছি। তোমার সাহায্যের হাত বাড়াও এবং আমাকে রক্ষা করো।
যাকে তুমি পেছনে ফেলে যাও সে বিপর্যয়ে পড়ে।
যদি তোমার রহমত কেবল ভালোদের জন্য হয় তবে পাপীরা কোথায় যাবে?
হে আল্লাহ, তুমি সে যে মানুষের প্রার্থনা কবুল করে গভীর অন্ধকার রাতে,
হে আল্লাহ, তুমি সে যে যিনি কষ্ট, যন্ত্রণা আর বেদনা দূর করে,
তোমার লোকেরা তোমার ঘরের বাইরে ঘুমিয়ে আছে, আমার জন্য তোমার দরজা খুলে দাও!
কিন্তু তুমি চিরজাগ্রত, তুমি কখনও ঘুমাও না,
সর্বদা উপস্থিত এবং তোমার রহমত দিয়ে সবার উপরে নজর রাখো।
হে আল্লাহ! যারা আমার বিরুদ্ধে আসে তাদের ক্ষমা করো এবং আমাকে ক্ষমা করো কারণ তোমার জন্য আমার ভালোবাসা খাঁটি।
আমাকে তোমার সান্নিধ্যে উন্নীত করো, যেখানে আমি সর্বদা তোমাকে দেখব!
আমাকে তা দাও যা কেউ পেতে পারে না।
আমাকে তা দাও যা প্রতিটি মানুষ চায়, যা প্রতিটি পাখি চায়, যা প্রতিটি তিমি চায়, যা বনের প্রতিটি বন্য প্রাণী চায়!
পাখিরা গান গাইছে, তিমিরা শিস দিচ্ছে, বাতাস শিস দিচ্ছে, সিংহরা গর্জন করছে, সবই তাদের প্রভুর ভালোবাসায়! আপনারা কি মনে করেন জালালুদ্দিন রুমি (কাদ্দাসাল্লাহু সিররুহু)- এর মতো পুণ্যবান ব্যক্তিরা কি এই ভাষা বুঝতে পারেন না? ফিনিশিয়ান ভাষা শেখা আরও কঠিন। ৫০০০ বছর পরে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কিছু মানুষ এর পাঠোদ্ধার করতে এবং বুঝতে সক্ষম হয়েছিল। এবং মিশরীয় ভাষা ও এর হায়ারোগ্লিফিক্স ৫০০০ বছর আগের।
আজ তিমি মাছের পুকুরে ডুবুরিদের কথাই ধরুন, তাদের কাছে একটি বাঁশি থাকে এবং তারা তিমির দিকে শিস দেয় এবং তিমি তাদের পাল্টা শিস দেয়। তারা তিমির ভাষা বোঝে। তারা কীভাবে তিমির ভাষা বোঝে? এটি একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মাধ্যমে এবং আমাদের করা প্রতিটি শব্দের একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য আছে যা কিছু পুণ্যবান মানুষ শুনতে পান। কখনও কখনও এমনকি আপনার কথা বলা ছাড়াও! তারা শুনতে পান আপনার হৃদয়ে কী আসছে যা নিয়ে আপনার হৃদয় আপনাকে কথা বলতে বলছে, তারা তা আগেই শুনতে পান। অন্তর থেকে সেই মন্তব্য আসার আগ পর্যন্ত, যতক্ষণ আপনি এটি আপনার হৃদয়ে গড়ে তুলছেন এবং এটি আপনার স্নায়ুতন্ত্রে যাচ্ছে যাতে আপনার মন জিহ্বাকে কথা বলার আদেশ দেয়, তাঁরা সেই মুহূর্তে ধরে ফেলবেন আপনি কী বলতে যাচ্ছেন এবং তাঁরা আপনাকে বলেন "তুমি এটাই ভাবছ।"
এই মানুষগুলো সব জায়গায় আছে, তাই তাদের খুঁজুন কারণ তারা লুকিয়ে নেই! আমরা যদি প্রাণীর সাথে কথা বলতে পারি তবে কি আমরা একে অপরের সাথে কথা বলতে পারি না এবং একে অপরের প্রতি ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করতে পারি না? জঙ্গলে যান এবং দেখুন কীভাবে প্রাণীরা একে অপরের প্রতি তাদের ভালোবাসা দেখায়। আল্লাহ বা স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কে আপনারা কী মনে করেন? নবীদের প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কে কী? গোপন সত্তার প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কে কী? আল্লাহ মুসা (আ.)-কে একজন গোপন ব্যক্তির কাছে পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহর এক বান্দা মুসা (আ.)-এর জন্য অপেক্ষা করছিলেন কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার জন্য এবং আপনারা অনেকেই সেই গল্প জানেন।
তাই সমস্যাটি আমাদের হৃদয়ে নিহিত। তাই হৃদয়ের রোগ থেকে মুক্তি পেলে আপনি সুস্থ হবেন। তাই আধ্যাত্মিকতায় প্রেমাস্পদকে ডাকতে হলে আপনাকে আপনার নফস বা আত্মাকে সব কিছু থেকে পরিষ্কার করতে হবে যা তার সাথে যুক্ত আছে, নতুবা আপনি প্রেমাস্পদকে ডাকতে পারবেন না। আপনি যখন প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করতে যান তখন কীভাবে পোশাক পরেন? আপনি সেরা পোশাক পরেন এবং আপনার পকেটে কী থাকে? একটি পারফিউম বা আতর। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আপনি সুগন্ধি মাখেন যাতে সুঘ্রাণ ছড়ায় এবং সেটা দিতে দিতেই আপনি উপরে যান নিরাপত্তারক্ষীরা তা নিয়ে নেওয়ার আগেই। (হাসি) তাই প্রেমাস্পদকে ডাকার সময় সুগন্ধি মাখার ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন? এটি পারফিউম নেওয়া নয় বরং এটি হলো খারাপ রোগগুলো দূর করা যা হৃদয়ে দুর্গন্ধ তৈরি করে।
কিছু মানুষের হার্টে ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। এগুলো হলো বিভিন্ন প্রক্রিয়া যা আমাদের অনুসরণ করতে হবে যাতে আমরা শুনতে পারি যেমন জালালুদ্দিন রুমি শুনছিলেন যখন তিনি ঘুরছিলেন এবং তাঁর কবিতার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করছিলেন। তিনি উপরে উঠছিলেন এবং আল্লাহর সাড়া শুনতে পাচ্ছিলেন। আমাদের এটাই প্রয়োজন, আমাদের সাড়া শোনা প্রয়োজন! আমরা এখান থেকে বলি "হে আমার প্রভু!" আপনারা কি মনে করেন তিনি বলবেন না "হে আমার বান্দা!" তিনি বলবেন "হে আমার বান্দা!" তাই হৃদয়ের রোগ বা 'আমরাদ আল-কালব' হলো:
১. কপট হৃদয় (The Hypocritical Heart)
আপনি আপনার হৃদয়ে যা আছে তা গোপন করেন এবং মুখে যা বলেন তা আপনার হৃদয়ের বিপরীত। 'ইয়াকুলুনা বি-আলসিনতিহিম মা লাইসা ফি কুলুবিহিম', তারা তাদের জিহ্বা দিয়ে তা বলে যা তাদের অন্তরে নেই। এর মানে তারা মুনাফিক বা কপট, তারা সত্য গোপন করে এবং মিথ্যা বলে। আমাদের জীবন থেকে এটি দূর করতে হবে যাতে আমাদের হৃদয় একটি ভালো হৃদয় হয়।
২. সন্দিগ্ধ বা সন্দেহগ্রস্ত হৃদয় (The Doubtful Heart)
যে হৃদয় সর্বদা অন্যদের সম্পর্কে খারাপ চিন্তা করে। আপনি যদি মানুষকে সন্দেহ করেন তবে আপনার কর্তব্য হলো আপনি যাকে সন্দেহ করছেন তার কাছে যাওয়া এবং তাকে জিজ্ঞাসা করা "আমার এই সমস্যা হচ্ছে, আপনি কি আমার কাছে এটি পরিষ্কার করতে পারেন?" তাই মানুষকে সন্দেহ করবেন না।
৩. সন্দেহপ্রবণ হৃদয় (The Suspicious Heart)
যে হৃদয় সর্বদা সন্দেহপ্রবণ, ভাবে "ওহ! তারা আমার সাথে এটা করতে চায়, তারা আমাকে মেরে ফেলতে চায়, তারা এটা-ওটা করতে চায়, স্কুলে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক ভালো না, তিনি আমার ভালো চান না।” কিন্তু, ইয়েলে হয়তো এমনটা নেই, হয়তো হার্ভার্ডে আছে! (মাওলানার হাসি)
৪. বক্র হৃদয় (The Deviated Heart)
যে হৃদয় কর্কশ ও সংকুচিত হয়ে গেছে। আপনি তাদের সাথে কথা বলে্ কিন্তু, তারা আপনার কথা শুনতে চায় না এবং তারা আপনাকে খারাপ বা নেতিবাচক উত্তর দেয়। আল্লাহ এটি পছন্দ করেন না। এবং শেষটি হলো:
৫. উদাসীন হৃদয় (The Heedless Heart)
এটি সর্বদা ঘুমিয়ে থাকে এবং সে জানে না কী ঘটছে। সে গাফিল বা উদাসীন। ঘৃণা ও হিংসার কারণে সেই হৃদয় কারো কথা শুনতে চায় না।
তাই যদি আমরা আমাদের হৃদয় থেকে এসব দূর করি, যখন আমরা ডাকব তখন আমরা উত্তর শুনতে পাব। আমাদের এই আকাঙ্ক্ষা এবং অনুভূতির প্রকাশ শুধু কবিতা লেখার ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, কবিতায় অনুভুতির প্রকাশের বিষয়টি ভালো। কিন্তু, আল্লাহর পক্ষ থেকে সাড়া না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের প্রতিনিয়তই ডাকার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এবং সেই সাড়াটা কী? এটি হলো আপনার অন্তরে একটি ইলহাম বা ওহী (প্রেরণা)।
পরিশেষে, আমি এই বিষয়টি স্পর্শ করতে চাইনি কিন্তু প্রথমে আমি বলতে চাই জীবনে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যা সমস্ত নবীরা উল্লেখ করেছেন এবং সাইয়্যিদিনা মুহাম্মদ ﷺ ও উল্লেখ করেছেন। তা হলো "উত্তম চরিত্র, যদি আপনি চান আপনার দোয়া আপনার প্রভুর কাছে পৌঁছাক তবে আপনার তিনটি ভালো বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজন।" সেগুলো হলো:
১) 'আন তাসিলা মান কাতা'আক', যে আপনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। অথবা যদি কেউ আপনার সাথে কথা না বলে তবে শান্তি স্থাপনের জন্য তার সাথে একটি সেতু তৈরি করার চেষ্টা করা। অনেক মানুষ আছে যারা একে অপরের বিরুদ্ধে: স্বামী, স্ত্রী, সন্তান, বিবাহিত সন্তান, অবিবাহিত সন্তান; তাদের সমস্যা আছে। এবং কী বলা হয়েছে? বলা হয়েছে যে আপনাকে তার সাথে যুক্ত হতে হবে যে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করেছে। তাই যে আপনাকে উভয় দিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে আপনাকে ফিরে যাওয়ার সেতু তৈরি করতে হবে।
২) 'ওয়া তু'তি মান হারামাউক', এবং তাকে দেওয়া যে আপনাকে আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস বা আপনার জন্য যা লিখিত ছিল তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত করেছে। কিন্তু সে এমন খেলা খেলেছে যে আপনার যা প্রাপ্য ছিল তা কেড়ে নিয়েছে এবং এখন তা তার। আল্লাহ বলেন "কিছু মনে করো না, তার সাথে একটি সেতু (বন্ধন) তৈরি করো।"
৩) 'ওয়া তা'ফু আম্মান জলামাক', এবং যে আপনার ওপর জুলুম করেছে তাকে ক্ষমা করা। তাকে ক্ষমা করুন সেই প্রেমাস্পদের জন্য যার সম্পর্কে আমরা আজ সন্ধ্যায় কথা বলছি।
আমি এই বিষয়টি স্পর্শ করতে চাইনি কিন্তু সঙ্গীত এবং কবিতা সম্পর্কে জানা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, এই বিষয়টা নিয়ে ইসলামে আলেমদের মধ্যে মত পার্থক্য আছে। আমি ভেবেছিলাম ড. হুমায়রা এটি নিয়ে কথা বলবেন, কিন্তু, তিনি মনে হয় আমার জন্য রেখে দিয়েছেন। এমন আলেম আছেন যারা বলেন গান গাওয়া যাবে না বা বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। অন্যরা বলেন এটি অনুমোদিত। আমি এটি বলছি কারণ আমরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি, আমরা জানি যে ইসলাম ধর্মে হালাল আছে এবং হারাম আছে, বৈধ এবং নিষিদ্ধ দুটোই আছে। নবীজী ﷺ যা হালাল বা ভালো হিসেবে উল্লেখ করেছেন তা ভালো, এতে কোনো প্রশ্ন নেই। এবং তিনি যা হারাম বা ভালো নয় বলে উল্লেখ করেছেন তা ভালো নয়, বিনা প্রশ্নে। কিন্তু এর মাঝখানে একটি ধূসর এলাকা বা 'গ্রে এরিয়া' আছে। তাই যে বিষয়গুলোতে মতভেদ আছে বা এই ধূসর এলাকায় পড়ে আপনি সেক্ষেত্রে আপনার পছন্দের মতটি গ্রহণ করতে পারেন, এটি অনুমোদিত। সঙ্গীত এবং কবিতা সম্পর্কে মতামত উল্লেখ করা বড় আলেমদের একজন হলেন ইমাম আল-গাজ্জালি (কাদ্দাসাল্লাহু সিররুহু), আমি মনে করি যার কথা সবাই শুনেছেন। আমি পাঠ্য বা টেক্সটে যাব না। কিন্তু তিনি বলেছেন যে সঙ্গীত এবং কবিতা ইসলামে গ্রহণযোগ্য।
সম্প্রতি মিশরের মুফতি ড. আলী গোমা এ বিষয়ে একটি ফতোয়া বা আইনি রায় দিয়েছেন। যেখানে তিনি বলেছেন, "সঙ্গীত এবং সঙ্গীত শোনা সম্পর্কে যে আলেমরা সঙ্গীত বৈধতার পক্ষে রায় দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ইমাম আল-গাজ্জালি অন্যতম।" তিনি ইমাম আল-গাজ্জালি (কাদ্দাসাল্লাহু সিররুহু) -এর ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন।
আল-ইজ ইবনে আবদুস সালাম, ইসলামের অন্যতম বিখ্যাত আলেম, বলেছেন, "নসিহত ও স্মরণ করিয়ে দেওয়া যা আলোচনার মাধ্যমেও হতে পারে এবং এটি গান ও গীতিকবিতার মাধ্যমেও হতে পারে। এবং এটি সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমেও হতে পারে যার বৈধতা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে।" তিনি এটিকে অনুমোদিত বা বৈধ হিসেবে গ্রহণ করেছেন যদিও এমন মত আছে যা বলে এটি নাও হতে পারে।
এবং সবশেষে আমি এমন একটি বিষয় উল্লেখ করব যা আমাকে অবাক করেছে। এটি মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের তাদের অফিসিয়াল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত। এবং আমরা জানি মুসলিম ব্রাদারহুড কঠোর এবং খুব একটা প্রগতিশীল নয়, বরং, বিতর্কিত এবং কিছু বিষয়ে বেশি কঠোর। কিন্তু সঙ্গীতের এই বিষয়ে তারা কঠোড় না। এবং এটি সত্যিই ইতিবাচক ব্যাপার, কারণ, এটি আপনাকে একটি অবস্থান দেয় যে, যেসব আলেমরা শরিয়ত বিষয়ে কঠোর তারাও সঙ্গীত এবং কবিতার বৈধতা দিচ্ছেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের অফিসিয়াল ম্যাগাজিন, সংখ্যা ৫-এ "ইসলামি সঙ্গীত" শিরোনামের অধীনে:
সিম্ফনিগুলোগুলোর মাধ্যমে সঙ্গীতের সর্বোচ্চ স্তরের প্রতিভা প্রকাশিত হয়, যেমন: বিথোভেন, শোয়ার্জ, মোজার্ট, চাইকোভস্কি মানুষের কাছে প্রকৃতির আবেগ এবং অনুভূতি তুলে ধরেছেন। সিম্ফনি সাজানোর ক্ষেত্রে বাদ্যযন্ত্র বাজানোয় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিশেষজ্ঞকে একত্র করা হয় এবং সাজানো হয় যাতে তারা মানুষের আত্ম-উপলব্ধির যতটা সম্ভব কাছাকাছি পৌঁছাতে সফল হতে পারে।
অর্থাৎ, মুসলিম ব্রাদারহুডও ইসলামে সঙ্গীত এবং কবিতার বৈধতার সাথে একমত।
এর ফলে বিভিন্ন মিশরীয় সিম্ফোনিক ব্যান্ড গঠিত হয়েছিল, প্রতিটিতে ত্রিশজনও বেশি বাদক ছিল। মিশরের খ্রিস্টান যুব সমিতি তাদেরকে সাহায্য করেছিল এবং তারা কায়রোর আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠানও করেছিল। সঙ্গীতের জগতে বিশাল সুযোগ তৈরি করার লক্ষ্যে একটি নতুন ধারার প্রচার এবং বিকাশ করা আমাদের পক্ষ থেকে অত্যন্ত জরুরি, কারণ, কবিতা-সঙ্গীত আমাদেরকে একটি উচ্চতর পার্থিব অবস্থানে পৌঁছাতে সক্ষম করবে। আমরা সঙ্গীতের একটি নতুন রূপ সংজ্ঞায়িত করব যা মানুষের হৃদয়ে পৌঁছাতে সক্ষম হবে এবং এটি "মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গীত"-এর পরিবর্তে "ইসলামি সঙ্গীত" হিসেবে পরিচিত হবে।
তাই তারা নাম পরিবর্তন করেছে, আর কিছুই নয়। তাই আগে যেমন এটি হারাম ছিল "ওরিয়েন্টাল মিউজিক" বা প্রাচ্যের সঙ্গীত হিসেবে পরিচিত হয়ে, এটি "ইসলামি সঙ্গীত" লেবেল লাগিয়ে হালাল হয়ে গেল। অথচ, সঙ্গীতে কোনো পরিবর্তন নেই। আমি এটি উল্লেখ করেছি কারণ আমি সেই ফতোয়াটি পছন্দ করেছি। কারণ এটি দেখায় ইসলাম কতটা নমনীয়। যেখানে অনেক আলেম একটি মধ্যম পথ দিয়েছেন যাতে মানুষ যা অনুসরণ করতে চায় তা অনুসরণ করতে পারে। এজন্যই আমরা বলি যে কবিতা এবং সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রেমাস্পদকে আহ্বান করা যেতে পারে। কারণ এটি মানুষের অনুভূতি প্রকাশ করতে সাহায্য করে এবং তাদের শেখায় কীভাবে তাদের প্রভুকে ডাকতে হয়।
আল্লাহ আপনাদেরকে বরকত দিন এবং আল্লাহ এই সমাবেশকে বরকত দিন এবং আপনাদের এমন সময় এবং সুযোগ দান করুন যাতে সর্বদা তাঁকে ডাকতে পারেন এবং আপনারা যাকে ভালোবাসেন তাকে ডাকতে পারেন, আপনারা যে ধর্মেরই হোন না কেন। আমরা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের কথা বলছি না বরং আমরা সার্বিকভাবেই কথাগুলো বলছি। আপনি যে ধর্মই অনুসরণ করেন, বা, যে বিশ্বাসেই থাকেন, আপনি সেই ধর্মের ভেতর থেকেই যাকে ভালোবাসেন তাকে ডাকতে পারেন!
আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন! আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
১৯৪৫ সালে বৈরুতের ধর্ম এবং জ্ঞানের আবহে পরিবেষ্টিত এক বিশিষ্ট পরিবারে জন্ম নেওয়া শেখ মুহাম্মদ হিশাম আল-কাব্বানী ছিলেন বিশ্বপ্রসিদ্ধ মুসলিম পণ্ডিত, আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের গবেষক, লেখক, আন্তঃধর্মীয় সংলাপের পথিকৃৎ এবং নক্সেবন্দি সুফি তরিকার শিক্ষক। সিরিয়ার দামেস্কে তিনি ইসলামি আইন (শরিয়াহ) শিক্ষা অর্জন করেন। আধ্যাত্মিকতায় তিনি নকশবন্দি তরিকার দুই খ্যাতিমান শিক্ষক—শেখ আবদুল্লাহ আল-ফায়িজ আদ-দাগেস্তানি ও শেখ নাজিম আদিল আল-হাক্কানীর শিষ্যত্ব লাভ করেন।
বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি রসায়নে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরে বেলজিয়ামের লুভেনে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তিনি ইসলাম ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা, বিশ্বধর্ম, মানবতাবাদ, মানবাধিকার, নারীদের অধিকার থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্য, দর্শনসহ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন।
শেখ মুহাম্মদ হিশাম আল-কাব্বানী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ও আধ্যাত্মিক কেন্দ্রগুলোতে লেকচার দিয়েছেন। তাঁর বক্তৃতা ও আলোচনার বিষয় ছিল ইসলামি আইন, সুফিবাদ, আধ্যাত্মিকতা, শান্তি, সহনশীলতা ও আধুনিক বিশ্বের নানান চ্যালেঞ্জ। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়, রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়, হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়, কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং কানাডার ডসন কলেজসহ আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লেকচার দিয়েছেন।
শেখ হিশামের গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হলো আধ্যাত্মিকতা ও মানবতার শিক্ষার প্রসার। তিনি অনেক প্রবন্ধ, বক্তৃতা এবং বই প্রকাশ করেছেন, যা ইসলামের ঐতিহ্য, নকশবন্দি সুফি ধারা, আধ্যাত্মিক প্রার্থনা এবং মানবকল্যাণের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। তার উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে Illuminations: Compiled Lectures on Shariah and Tasawwuf, The Naqshbandi Sufi Way: History and Guidebook of the Saints of the Golden Chain, The Sufi Science of Self‑Realization, Encyclopedia of Islamic Doctrine and Beliefs, Angels Unveiled: A Sufi Perspective, Symphony of Remembrance, Universe Rising, এবং Call on Me: Powerful Supplications for Healing, Protection & Fulfillment of Needs। এই প্রকাশনা এবং লেকচারগুলো তাকে আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামী শিক্ষা, আধ্যাত্মিকতা ও মানবতাবাদী চিন্তাধারার একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
শেখ হিশাম আল-কাব্বানী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শান্তি, ধর্মীয় সংলাপ ও মধ্যপন্থী ইসলামের প্রচারক প্রতিষ্ঠান Islamic Supreme Council of America (ISCA)-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতিসংঘসহ বহু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি ইসলামের শান্তি ও সহনশীলতার বার্তা তুলে ধরেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরেও ইসলাম, সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় সহনশীলতা বিষয়ে তিনি নিয়মিত পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন এবং সারা বিশ্বে শান্তি, সহনশীলতা ও মানবতার বার্তা ছড়িয়ে গেছেন। বিশ্বের বহু রাষ্ট্রপ্রধান ও নীতিনির্ধারকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি ইসলামের মর্মবাণী তুলে ধরেছেন।
২০২৪ সালের ৪ ডিসেম্বর তিনি দুনিয়া ত্যাগ করে অনন্ত জীবনে যাত্রা করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা, দর্শনের প্রভাব সারাবিশ্বেই ক্রমবর্ধমান। বিশ্বের নানান প্রান্তের গবেষক, চিন্তাবিদগণ তাঁর বক্তব্য, দর্শন এবং আলোচনা দ্বারা প্রতিনিয়তই অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। তাঁর এই অনন্য প্রভাব কখনোই কমে আসবে না, বরং, সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পাবে বলেই ধারণা করা যায়।
