"দশ হাজার নির্বোধ": কাফকার চোখে রাজনীতির বিদ্রূপাত্মক দর্শন


 "একজন নির্বোধ একজন নির্বোধই। দুজন নির্বোধ দুজন নির্বোধই। কিন্তু, দশ হাজার নির্বোধ একসাথে হলে তৈরি হয় একটি রাজনৈতিক দল।"

- ফ্রাঞ্জ কাফকা

ফ্রাঞ্জ কাফকা (Franz Kafka) তাঁর সাহিত্যে মানুষের বিচ্ছিন্নতা, আমলাতন্ত্রের জটিলতা এবং অস্তিত্বের প্রহেলিকা তুলে ধরেছেন। তাঁর এই অন্ধকারাচ্ছন্ন জগৎ থেকে উঠে আসা একটি উক্তি— "একজন নির্বোধ একজন নির্বোধই। দুজন নির্বোধ দুজন নির্বোধই। কিন্তু, দশ হাজার নির্বোধ একসাথে হলে তৈরি হয় একটি রাজনৈতিক দল"— আপাতদৃষ্টিতে সহজ হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে রাজনীতি এবং সমষ্টিগত বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এক তীব্র বিদ্রূপ। এই উক্তিটিকে কেবল একটি কৌতুক হিসেবে দেখলে ভুল হবে; এটি একটি গভীর দার্শনিক উপলব্ধি, যা ক্ষমতা এবং সংগঠনের প্রকৃতিকে প্রশ্ন করে।

১. নির্বোধের সমীকরণ

কাফকা শুরুতেই ব্যক্তিগত নির্বুদ্ধিতাকে (Idiocy) চিহ্নিত করেছেন। একজন বা দুজন নির্বোধ সমাজে বিশেষ কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। তারা বিচ্ছিন্ন, তাই তাদের ভুল বা বোকামিও ব্যক্তিগত গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। এখানে কাফকা যেন সেই ব্যক্তিকে দেখছেন, যে তার নিজস্ব সীমাবদ্ধতা নিয়েই বিদ্যমান। এই পর্যায়ে, নির্বুদ্ধিতা একটি ব্যক্তিগত ত্রুটি মাত্র।

২. সমষ্টির ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তার প্রশ্ন

উক্তির মোড় ঘুরে যায় যখন কাফকা দশ হাজার নির্বোধের কথা বলেন। প্রশ্ন হলো— দশ হাজার নির্বোধ একত্রে এলে কি তাদের নির্বুদ্ধিতা বিলুপ্ত হয়ে যায়? না। কাফকার মতে, যখন এই বিশাল সংখ্যক নির্বোধ একটি কাঠামোর (Structure) মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন সেই সমষ্টিগত নির্বুদ্ধিতা রূপ নেয় 'রাজনৈতিক দল'-এ।

এই বিশ্লেষণটি রাজনীতির মূল ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়। রাজনৈতিক দলগুলি সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ, দূরদর্শিতা এবং উদ্দেশ্য পূরণের জন্য গঠিত হয়। কিন্তু কাফকা ইঙ্গিত দিচ্ছেন, সংখ্যাধিক্য বা জনসমর্থন কোনো সংগঠনের বুদ্ধিমত্তা বা নৈতিকতা নিশ্চিত করে না। বরং, বিপুল সংখ্যক মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়া সেই ব্যক্তিগত নির্বুদ্ধিতাকে একটি সাংগঠনিক শক্তিতে পরিণত করে, যা সমাজের উপর সুদূরপ্রসারী ও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

৩. কাফকার আমলাতান্ত্রিক হতাশা

কাফকার জীবন ও সাহিত্যে আমলাতন্ত্র (Bureaucracy) এবং ক্ষমতা কাঠামোর প্রতি এক গভীর হতাশা ছিল। তিনি দেখেছিলেন কীভাবে সিস্টেম ব্যক্তিমানুষকে গ্রাস করে, তাদের যুক্তি ও স্বতন্ত্রতাকে কেড়ে নেয়। রাজনৈতিক দলগুলিও এক প্রকারের কাঠামোগত আমলাতন্ত্র। এই উক্তিটির মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন:

  • যুক্তি থেকে মুক্তি: একটি দল যখন হাজার হাজার নির্বোধকে একত্রিত করে, তখন যুক্তির চেয়ে আবেগের জয় হয়। সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত দুর্বলতা বা অন্ধ আনুগত্যকে কাজে লাগিয়ে দলগুলি শক্তি সঞ্চয় করে।

  • দায়মুক্তি: ব্যক্তিবিশেষ যখন একটি বৃহত্তর দলের অংশ হয়, তখন তারা তাদের ব্যক্তিগত কাজের দায়ভার এড়িয়ে যেতে পারে। দলীয় সিদ্ধান্ত বা আদর্শের আড়ালে নির্বোধের কাজগুলি বৈধতা পায়।

  • ক্ষমতার উৎসে বিদ্রূপ: কাফকা বলতে চেয়েছেন, যে সংস্থাটি সমাজে নেতৃত্ব দেয়, আইন তৈরি করে এবং দিকনির্দেশনা দেয়, তার জন্ম কেবল 'নির্বোধের সংখ্যাবৃদ্ধি'র মধ্য দিয়েও হতে পারে। এটি ক্ষমতার প্রতি তাঁর চিরন্তন সংশয় ও বিদ্রূপের প্রকাশ।

৪. আধুনিক সমাজে প্রাসঙ্গিকতা

কাফকার এই উক্তিটি আজও তীব্রভাবে প্রাসঙ্গিক। যখন আমরা দেখি কীভাবে একটি দল বা আদর্শের নামে অন্ধ অনুসরণ, জনতুষ্টি (Populism) এবং যুক্তিরহিত প্রচার সহজেই বিশাল জনসমর্থন পায়, তখন কাফকার কথাগুলি সত্য বলে মনে হয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংখ্যাধিক্য অনেক সময় গুণমানকে ছাপিয়ে যায়, এবং এই উক্তিটি যেন সেই নির্মম সত্যকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

কাফকার এই উক্তিটি রাজনীতিকে ব্যক্তিগত নৈতিকতা বা বুদ্ধিমত্তার মাপকাঠিতে দেখতে শেখায়। এটি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমালোচনা নয়, বরং রাজনৈতিক সংগঠনের কাঠামোগত দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, একটি শক্তিশালী সংগঠন গঠনের জন্য কেবল লোকবল নয়, বরং গভীর বিচার-বুদ্ধি, মানবিকতা এবং সত্যের প্রতি আনুগত্য থাকা প্রয়োজন। নয়তো, দশ হাজার নির্বোধের সম্মিলিত চিৎকারে গণতন্ত্রের মূল সুরটিই চাপা পড়ে যেতে পারে।


#সাহিত্যনামা

#বর্তমানরাজনীতি

নবীনতর পূর্বতন