কথার জাদুকর: শুভ জন্মদিন হুমায়ূন আহমেদ
আজ ১৩ নভেম্বর, বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি পুরুষ, কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। তিনি এমন একজন স্রষ্টা, যিনি কলমের স্পর্শে বাঙালি মধ্যবিত্তের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নাকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। তাঁর সৃষ্টিতে বুঁদ হয়নি, এমন পাঠক বা দর্শক খুঁজে পাওয়া ভার। জন্মদিনে এই মহান সাহিত্যিককে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
সংক্ষিপ্ত জীবনী: রসায়ন থেকে রসসাহিত্য
হুমায়ূন আহমেদের জীবনকাল (১৯৪৮-২০১২) বর্ণাঢ্য এবং বৈচিত্র্যময়। তাঁর আনুষ্ঠানিক পরিচয় কেবল একজন লেখক হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল না।
* জন্ম ও পরিবার: ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জে (মতান্তরে কেন্দুয়ার কুতুবপুর) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহীদ হন। মা আয়েশা ফয়েজ।
* একাডেমিক পড়াশোনা: হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্র। তিনি ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন (Chemistry) বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি প্রথম শ্রেণীতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।
* গবেষণা (পিএইচডি): উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন (Polymer Chemistry) বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
* কর্মজীবন: পড়াশোনা শেষে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। তবে লেখালেখি ও চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যস্ততায় একসময় তিনি অধ্যাপনা থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।
সাহিত্যকর্ম: যে মোহ তিনি ছড়িয়েছিলেন
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য জগত বিশাল। তিনি দুই শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর প্রধান বিচরণক্ষেত্র ছিল উপন্যাস ও ছোটগল্প, তবে নাটক, চলচ্চিত্র, গান ও আত্মজীবনীতেও তিনি ছিলেন অসামান্য।
* উপন্যাস: ছাত্রজীবনেই তাঁর প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকে' (১৯৭২) প্রকাশিত হলে পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত হন। এরপর 'শঙ্খনীল কারাগার' তাঁকে এনে দেয় স্থায়ী আসন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে:
* মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক: আগুনের পরশমণি, জোছনা ও জননীর গল্প।
* জনপ্রিয় ধারা: কবি, কৃষ্ণপক্ষ, অপেক্ষা, এইসব দিনরাত্রি।
* চরিত্র ভিত্তিক: তিনি 'হিমু' এবং 'মিসির আলি' নামে দুটি কালজয়ী চরিত্র সৃষ্টি করেন, যা পাঠকদের মধ্যে তীব্র আলোড়ন তৈরি করে।
* টেলিভিশন নাটক: আশির দশকে টিভি নাটকের মাধ্যমে তিনি দেশের সর্বস্তরের দর্শকের কাছে পৌঁছে যান। তাঁর রচিত ও পরিচালিত নাটকগুলো বাংলাদেশ টেলিভিশনের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
* এইসব দিনরাত্রি
* বহুব্রীহি
* অয়োময়
* কোথাও কেউ নেই
* আজ রবিবার
* চলচ্চিত্র: তিনি ৮টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যার প্রতিটিই মুক্তিযুদ্ধ বা জীবনধর্মী গল্পের জন্য প্রশংসিত হয়েছে। যেমন: আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, ঘেটুপুত্র কমলা।
কিছু ইনফ্লুয়েনশিয়াল ঘটনা
হুমায়ূন আহমেদের জীবন ও কর্ম নানাভাবে বাংলাদেশের সমাজকে প্রভাবিত করেছে।
১. ১৯৭১-এর অভিঘাত: মুক্তিযুদ্ধ তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় প্রভাবক ঘটনা। তিনি বাবাকে হারান, নিজেও পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি ও নির্যাতিত হয়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে ফেরেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁর 'আগুনের পরশমণি' বা 'জোছনা ও জননীর গল্প'-এর মতো সৃষ্টির মূল প্রেরণা।
২. 'বাকের ভাই'-এর ফাঁসি: তাঁর রচিত 'কোথাও কেউ নেই' নাটকের কাল্পনিক চরিত্র 'বাকের ভাই'-এর (আসাদুজ্জামান নূর অভিনীত) যেন ফাঁসি না হয়, তার দাবিতে দেশের মানুষ সত্যিই রাস্তায় নেমে মিছিল করেছিল। এটি একটি কাল্পনিক চরিত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসার অভূতপূর্ব নিদর্শন, যা হুমায়ূন আহমেদের লেখনীর প্রভাবকে প্রমাণ করে।
৩. অধ্যাপনা ত্যাগ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার মতো নিশ্চিত ও সম্মানজনক পেশা ছেড়ে লেখালেখি ও নির্মাণের অনিশ্চিত জগতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করা—এই সিদ্ধান্তটি নব্বইয়ের দশকে একটি বড় ঘটনা ছিল, যা অনেককে নিজস্ব স্বপ্ন অনুসরণে অনুপ্রাণিত করেছে।
৪. নুহাশ পল্লী প্রতিষ্ঠা: গাজীপুরে তিনি গড়ে তোলেন তাঁর স্বপ্নের বাগানবাড়ি 'নুহাশ পল্লী'। এটি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত আশ্রয় ছিল না, বরং এটি তাঁর শিল্পমনন ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার এক অনন্য নিদর্শন হয়ে উঠেছে।
হুমায়ূন আহমেদ আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকর্ম তাঁকে অমর করে রেখেছে। যতদিন বাংলা ভাষাভাষী মানুষ থাকবে, ততদিন হিমু, মিসির আলি আর বাকের ভাইদের মাধ্যমে তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে।
#সাহিত্যনামা